ফাহিম মাশরুর
প্রশ্ন করেছেন


এটি একটি প্রচলিত বিশ্বাস যে এতে নাকি বাচ্চাটি মিষ্টভাষী হবে যা নির্ঘাত কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুনা। কিন্তু যেহেতু এগুলো জীবাণুমুক্ত নয় তা খাওয়ানোর পর শিশুর বমি, পাতলা পায়খানা বা অন্যান্য পেটের পীড়া দেখা দিতে পারে৷ তাই নবজাতক শিশুকে চিনির পানি বা মধু খাওয়ানো মোটেই উচিত নয়৷ তাছাড়া প্রথম খাদ্য হিসেবে মধু দিলে শিশুর হজমে সমস্যা হতে পারে, তাই এর স্বাস্থ্যগত অপকারিতাই আছে উপকারিতার প্রশ্নই আসেনা। সুতরাং শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর মায়ের বুকে যে শাল দুধ আসে সেটাই হওয়া উচিত তার প্রথম খাবার। গ্রামের মহিলারা অবশ্য অজ্ঞতা বশত এ দুধ ফেলে দেন। তারা মনে করেন এ ঘন দুধ খাওয়ালে শিশুর অমঙ্গল হবে। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে “কেলোস্ট্রাম”। এতে প্রচুর শ্বেত রক্ত কণিকা থাকায় তা রোগের সংক্রামণকে প্রতিহত করে। এ দুধ পান করা শিশুরা পেট ও বুকের সমস্যায় কম ভোগে। তাই একে শিশুর প্রথম টিকা বলা যায়।

আমাদের দেশে এটি প্রচলিত প্রথা যে জন্মের পর পরই নবজাতকের জীভে মধু ছোয়ানো হয়। এটি একটি প্রচলিত বিশ্বাস যে এতে নাকি বাচ্চাটি মিষ্টভাষী হবে। মোটামোটি আমরা সবাই জানি যে এটা কুসংস্কার বৈ অন্য কিছু না। তারপরেও অভ্যাসের বশে অথবা মুরব্বীদের মন রক্ষার্থে আমরা আমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রেও এই প্রথা অনুসরণ করি। কিন্তু আপনি জানেন কি যে এর মাধ্যমে আপনি আপনার সন্তানের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারেন? পাশ্চাত্য দেশ গুলোতে এক বছর কম বয়সী বাচ্চাদের মধু খাওয়াতে ডাক্তাররা কড়াকড়ি ভাবে নিষেধ করেন। কাচা মধু তে বটুলিসম রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বীজ (স্পোর) থাকতে পারে। পূর্ণ বয়স্ক মানুষ যখন মধু সেবন করেন, তার পাকস্থলির এসিড এই ব্যাকটেরিয়ার বীজ (স্পোর) কে ধ্বংস করে ফেলে। কিন্তু এক বছর চেয়ে কম বয়সের বাচ্চার পাকস্থলিতে পূর্ণবয়স্কদের মত অতটা এসিড থাকেনা (এই পরিমাণ এসিড তৈরী করতে তার বয়স এক বছর হতে হয়), তাই সে সহজেই বটুলিসম রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বটুলিসম রোগের ব্যাকটেরিয়া প্রথমে বাচ্চার অন্ত্রে বংশ বিস্তার করে। এরপর ধীরে ধীরে এটি একটি বিষ (টক্সিন) নিঃসরন করতে থাকে। এই বিষ রক্তে মিশে বাচ্চাকে প্যারালাইসড করে ফেলে। চূড়ান্ত পর্যায়ে বাচ্চারফুসফুস প্যারালাইসড হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে বাচ্চাটির মৃত্যু ঘটে। মধু দ্বারা বাচ্চাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রমাণ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে নানা গবেষনায় প্রমাণিত হয়েছে । মুরব্বীদের মন রক্ষার্থে মধু যদি খাওয়াতেই হয়, চাকভাঙ্গা খাটি মধুনা খাইয়ে বাজারে সহজলভ্য বোতল জাত মধু গুলো খাওয়ান। বোতলজাত মধু“পাস্তুরাইজেশন” পদ্ধতিতে জীবানুমুক্ত করা হয় যাতে কোন জীবানু থাকেনা। কেনার আগে অবশ্যই বোতলে “পাস্তুরিত”কথাটা লেখা আছে কিনা দেখে কিনবেন।

নবজাতককে মধু খাওয়ালে তার কন্ঠ স্বর সুন্দর, স্পট হয়। তাছাড়াও মধু স্বাস্থোর জন্য উপকারি। এটা বিজ্ঞান দ্বারা পমানিত।

লোকজ সংস্কারই বটে। মধূ উপকারী, সন্দেহ নেই। তবে, নবজাতকের জন্য মায়ের শালদুধই প্রথম খাদ্য হওয়া উচিত, মধূ বা অন্যকিছু নয়। শিশুদের মধু দেওয়া যেতে পারে ছয় মাস বয়সের পর, যখন সে মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবারও খেতে শুরু করবে। (তখন শিশুকে রঙ চা-ও খাওয়ানো যেতে পারে। আমার দাদা আমাদের সবাইকে ছোটবেলায় রঙ চা খাইয়েছেন বলে শুনেছি। :) )

সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মুখে মধুর স্বাদ দেয়া আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত একটি প্রথা। এদেশের মানুষ এখনো বিশ্বাস করে এতে করে শিশুর কন্ঠ স্বর সুন্দর, স্পট হয়,শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। যদিও এটা একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং এটার বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে মধু আল্লাহর নেয়ামত একটি উপকারী তরল খাদ্য। পবিত্র কোরআন শরীফে সুরা না'হল-এ মধুর গুনের কথা উল্লেখ আছে।তবে নবজাতকদের জন্য মধু একটি আদর্শ আর উপকারী খাদ্য নয় বেশ কয়েকটি কারনে। সেটা উল্লেখ করার চেষ্টা করছি। ১ / মধু একটি বিশুদ্ধ খাবার কোন সন্দেহ নেই কিন্তু এটার আহরণ আর সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সব সময় সঠিক নিয়মে হয় না বিধায় এটা শিশুর জন্য উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি করতে পারে। ২ / যে শিশুর প্রথম খাবার মিষ্টি হবে সেটা মধু আর মিছরি যাই হোক না কেন তাকে আর অন্য খাবার খাওয়ানো যায় না, সব খাবারেই সে মিষ্টি স্বাদ আশা করে। ৩ / মধু একটি গুরুপাক খাদ্য তাই শিশুরা সহজে তা হজম করতে পারে না। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন সেটা হল ১ বছরের নীচে শিশুদের চিকিৎসকরা গরুর দুধ খাওয়াতে নিষেধ করেন কারন এই দুধ লঘুপাক নয় তবে একান্তই যদি খাওয়ানোর প্রয়োজন হয় তবে পানি মিশিয়ে পাতলা করে খেতে দিতে বলেন। পরিশেষে একটি কথাই বলা চলে নবজাতকদের মধু খাওয়ানোর মাঝে স্বাস্থ্যগত কোন উপকারী নেই এবং অনেক বরং খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনা থাকে।

জন্মের পরপর মুখে মধু বা চিনি দিলে শিশুর কথা মিষ্টি হবে — ব্যাপারটি ভ্রান্ত ধারণা, তবে এটি আমাদের বাঙালিদের প্রচলিত বিশ্বাস থেকে আজও প্রায় প্রতিটি ঘরেই নবজাতক জন্মের পর এই রীতি পালন করা হয়ে থাকে। জন্মের পর বেশি প্রয়োজন মায়ের বুকের প্রথম দুধ, যা শাল দুধ বলে পরিচিত। এটিই প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে বাচ্চার জন্য। হলুদ তরল বলে অনেকে এটা ফেলে দিতে বলেন। কিন্তু এই শালদুধেই আছে শিশুর প্রথম প্রয়োজনীয় পুষ্টি। তাই নবজাতককে মধু বা মিষ্টি জাতীয় কিছুই দেওয়া ঠিক না,এ সময়ে কারণ নবজাতকের এসব মিষ্টি খাবার হজমের ক্ষমতা তৈরি হয় না। জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো এবং ৬ মাস পর্যন্ত বুকের দুধ ছাড়া আর কিছু না খাওয়াতে নিরুৎসাহিত করেন চিকিৎসকেরা।

